SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - NCTB BOOK

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আলোর প্রয়োজনের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমরা চোখ বন্ধ করলে কিছুই দেখি না। আবার পুরোপুরি অন্ধকারে চোখ খোলা রাখলেও কিছু দেখতে পাই না। আলো হচ্ছে সেই নিমিত্ত, যার সাহায্যে আমরা দেখতে পাই। তোমরা আপের শ্রেণিগুলোতে আলোর বিভিন্ন ধর্মের সাথে পরিচিত হয়েছ। এই অধ্যায়ে আয়না বা দর্পণের ব্যবহার ছাড়াও আলোর প্রতিসরণ সম্পর্কে আরও কিছু জানবে। এছাড়া চোখের ক্রিয়া, স্পষ্ট দর্শনের নিকটতম বিন্দু, লেন্সের ক্ষমতা, চোখের ত্রুটি এবং লেন্স ব্যবহার করে চোখ ভালো রাখার উপায় জানতে পারবে।

 

এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা:

  • দর্পণের ব্যবহার ব্যাখ্যা করতে পারব।
  •  আলোর প্রতিসরণ ব্যাখ্যা করতে পারব ।
  • দৃষ্টি কার্যক্রমে চোখের ক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারব।
  •  স্পষ্ট দর্শনের নিকটতম বিন্দু ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • লেন্সের ক্ষমতা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • চোখের ত্রুটি সৃষ্টির কারণ ব্যাখ্যা করতে পারব ।
  • লেন্স ব্যবহার করে চোখের ত্রুটি সংশোধনের উপায় বর্ণনা করতে পারব।
  • চোখ ভালো রাখার উপায় ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • চোখের ত্রুটি সৃষ্টির কারণ অনুসন্ধান করতে পারব ।
  • চোখের প্রতি যত্ন নেব এবং অন্যদের সচেতন করব।
Content added By
(ক) উত্তল লেন্স
(খ) অবতল লেন্স
(গ) উত্তলাবতল লেন্স
(ঘ) সমতল বতল লেন্স

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আয়না বা দর্পণের নানা রকম ব্যবহার আছে। বর্তমান পাঠে আমরা আয়না বা দর্শণের দুটি বিশেষ ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করব। এ দুটি হলো নিরাপদ ড্রাইভিং এবং পাহাড়ি রাস্তার অদৃশ্য বাঁক বা পার্বত্য সড়কের বিপজ্জনক বাঁকে আয়না বা দর্পণের ব্যবহার।

নিরাপদ ড্রাইভিং

পাড়ি নিরাপদে ড্রাইভিং করার অন্যতম শর্ত হলো নিজ পাড়ির আশপাশে কী ঘটছে (চিত্র ৫.০১) সবসময় তা খেয়াল রাখা। সাধারণত গাড়ির ড্রাইভারের সিটের দরজার সামনের দিকে দুই পাশে সাইড ভিউ মিরর নামে দুটি আয়না বা দর্পণ থাকে। এছাড়া গাড়ির ভিতরে সামনের দিকে মাঝখানেও রিয়ার ভিউ মিরর নামে আরেকটি আয়না বা দর্পণ থাকে। এগুলো পাড়ির দুপাশে এবং পিছনের দিকে দেখার কাজে সাহায্য করে। ফলে ড্রাইভার শুধু মাথা ঘুরিয়েই চারপাশ দেখতে পারে তার শরীরে কোনো রকম মোচড় দিতে হয় না বা নাড়াতে হয় না ।

চিত্র ৫.০১: অনিরাপদ ড্রাইভিং

পাড়ির এই আয়নাগুলো ব্যবহার করে ড্রাইভার তার হাত সর্বদা স্টিয়ারিং হুইলে রেখে সামনে বা পিছনের দিকে নজর রাখতে পারে। গাড়ি চালানো শুরু করার আগে ড্রাইভার আরনা বা দৰ্পপগুলোকে (চিত্র ৫.০২ )

চিত্র ৫.০২: গাড়ির তিনটি আয়না।

যথাযথ অবস্থানে ঘুরিয়ে নেয় যেন ড্রাইভিং সিটে বসেই পিছন এবং দুপাশ সঠিকভাবে দেখা যায়। এর পাশাপাশি আয়নাগুলো ঠিক করে পরিষ্কার করে নিতে হয় যেন কোনো ময়লা বা ধূলাবালি না থাকে। এতে অন্য গাড়ির প্রতিবিম্বের অবস্থান ঠিকভাবে নাও বোঝা যেতে পারে। পাড়ি কোনো কারণে পিছানোর দরকার হলে প্রথমে তিনটি দর্পণেই চোখ বুলিয়ে নিতে হবে এবং গাড়িটি না থামানো পর্যন্ত সারাক্ষণ তিনটি দর্পণেই চোখ রাখতে হয়। তাছাড়া চলন্ত অবস্থায় গাড়ি সেন পরিবর্তন করার আগে এই তিনটি আয়না বা দর্পণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, যেন পিছনের গাড়ির অবস্থান বুঝা যায়।

পাহাড়ি রাস্তার অদৃশ্য বাঁক

পাহাড়ি রাস্তা সাধারণত আঁকাবাঁকা হয়। অনেক সময় এমনও বাঁক থাকে যে রাস্তাটি প্রায় ৯০° বেঁকে যায়। তখন সামনের রাস্তা দিয়ে কী আসছে বোঝার কোনো উপায় থাকে না— এই কারণে পাহাড়ি রাস্তায় ড্রাইভিং বিপজ্জনক। ড্রাইভিংকে নিরাপদ করার জন্য পাহাড়ি রাস্তায় বিভিন্ন বাঁকে বড় সাইজের গোলীয় দর্পণ স্ট্যান্ডে দাঁড় করে রাখা হয় (চিত্র ৫.০৩)। ফলে এর কাছাকাছি এসে দর্পণে তাকালে বাঁকের অন্য পাশ থেকে কোনো গাড়ি আসছে কি না সেটি দেখা যায় এবং ড্রাইভার সাবধান হয়ে পাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করে নিরাপদে গাড়ি চালাতে পারে।

চিত্র ৫.০৩: পাহাড়ি রাস্তার অদৃশ্য বাঁক

কাজ: একটা পাড়ির এই তিনটি আয়না পরীক্ষা করে দেখো। দেখবে এগুলো তোমাদের পরিচিত সমতল আয়না নয়। এর পৃষ্ঠদেশ বাঁকা বা এগুলো পোলীয় আয়না। এ কারণে এই আয়নার সবকিছু একটু ছোট দেখায় সত্যি কিন্তু এই আয়নায় অনেক বেশি এলাকা দেখা সম্ভব হয়।

Content added By

তোমরা অষ্টম শ্রেণিতে আলোর প্রতিসরণ এবং তার বাস্তব প্রয়োগ দেখেছ। আমরা জানি, আলোক রশ্মি কোনো স্বচ্ছ ও সমসত্ব মাধ্যমে সবসময় সরলরেখায় চলে। আলো যখন একটি স্বচ্ছ মাধ্যম থেকে অন্য স্বচ্ছ মাধ্যমে লম্বভাবে আপতিত না হয়ে বাঁকাভাবে আপতিত হয়, তখন মাধ্যম দুটির বিভেদতলে এর পতিপথের দিক পাল্টে যায়। আলোক রশ্মির দিক পরিবর্তন করার এই ঘটনাই হলো আলোর প্রতিসরণ।

 

চিত্র ৫.০৪: আলোর প্রতিসরণ

৫.০৪ চিত্রটি লক্ষ কর। এখানে উপরে বাতাস এবং নিচে পানি কল্পনা করা হয়েছে।

আলোকরশ্মি A থেকে শুরু করে O বিন্দুতে পড়েছে অর্থাৎ AD আপতিত রশ্মি এবং বিন্দু হলো আপতন বিন্দু। O বিন্দুর ভিতর দিয়ে NN' লম্ব আঁকা হয়েছে। প্রথম মাধ্যম বাতাস এবং দ্বিতীয় মাধ্যমটি পানি হওয়ায় এবং পানির ঘনত্ব বাতাস থেকে বেশি হওয়ায় আলোকরশ্মি সোজা OB পথে না গিয়ে ON'- এর দিকে সরে এসে OC বরাবর যাবে। এখানে OC হচ্ছে প্রতিসরিত রশ্মি।ZAON হলো আপতন কোণ এবং ZCON' হলো প্রতিসরণ কোণ। এখানে উল্লেখ্য, আলোক রশ্মি AC বরাবর আপতিত না হয়ে NO বরাবর আপতিত হতো তাহলে কিন্তু এটি সোজা ON' বরাবর চলে যেত।

কাজ: একটি কাপে একটি মুদ্রা রেখে তুমি তোমার মাথাটা এমনভাবে সরিয়ে নাও যেন মুদ্রাটি আর দেখা না যায়। এবারে কাপে পানি ঢালতে থাকো, তুমি এক সময় মুদ্রাটি দেখতে পাবে। শূন্য কাপে আলো সোজাসুজি তোমার চোখে আসতে না পারলেও পানি থাকার কারণে বাঁকা হয়ে সেটি তোমার চোখে পৌঁছাতে পারে।

 

প্রতিসরণের সূত্র: আলোর প্রতিসরণের সময় এর রশ্মির চলাচলের ধর্মকে দুটি সূত্রে প্রকাশ করা যায়।

১. আপতিত রশ্মি, আপতন বিন্দুতে বিভেদ তলের ওপর আঁকা অভিলম্ব এবং প্রতিসরিত রশ্মি একই সমতলে থাকে ।

২. এক জোড়া নির্দিষ্ট মাধ্যম এবং নির্দিষ্ট রঙের আলোর জন্য আপতন কোণের সাইন (sine) ও প্রতিসরণ কোণের সাইনের (sine') অনুপাত সর্বদাই ধ্রুব থাকে। অর্থাৎ sine / (sine') - n

দ্বিতীয় সূত্রে n হিসেবে যে খুব সংখ্যাটির কথা বলা হয়েছে, সেটি হলো নির্দিষ্ট রঙের জন্য প্রথম মাধ্যমের সাপেক্ষে দ্বিতীর মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক। প্রথম মাধ্যমকে শূন্য ধরে দ্বিতীয় মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক মাপা হলে সেটাকে বস্তুর প্রতিসরাঙ্ক বলা হয়। পানির প্রতিসরাঙ্ক ১.৩৩, বাতাসের প্রতিসরাঙ্ক ১-এর এত কাছাকাছি যে সেটাকে ১ ধরা হয়ে থাকে। তবে মনে রেখো, আলোর রং ভিন্ন বলে প্রতিসরাঙ্কের মানও একটুখানি ভিন্ন হয়।

 

চিত্র ৫.০৫: উত্তল লেন্স এবং তার ফোকাস বিন্দু

Content added By

দুটি গোলীয় পৃষ্ঠ দিয়ে সীমাবদ্ধ কোনো স্বচ্ছ প্রতিসারক মাধ্যমকে লেন্স বলে। অধিকাংশ লেন্স কাচের তৈরি হয়। তবে কোয়ার্টজ এবং প্লাস্টিক দিয়েও আজকাল গেল তৈরি হয় এবং এদের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।লেন্স সাধারণত দুই ধরনের।

(ক) উত্তল বা অভিসারী লেন্স (Convex lens) এবং

(খ) অবতল বা অপসারী লেন্স (Concave lens)

নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে উত্তল বা অভিসারী লেন্সে আলো রশ্মি হচ্ছে অভিসারী অর্থাৎ এক বিন্দুতে মিলিত হয়। অন্যদিকে অবভঙ্গ বা অপসারী লেন্সে আলোকরশ্মি অপসারী অর্থাৎ পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়।

চিত্র ৫.০৬: অবতল লেন এবং তার ফোকাস বিদু

চিত্রে ৫.০৫ হলো উত্তল লেন্স। এই লেন্সের মাঝখানে মোটা ও প্রান্ত সরু, তাই এটিকে কখনো কখনো স্থূলমধ্য লেন্সও বলা হয়। আলোকরশ্মি উত্তল লেন্সের উত্তল পৃষ্ঠে আপতিত হয়। এই লেন্স সমান্তরাল একগুচ্ছ আলোকরশ্মিকে কেন্দ্রীভূত বা অভিসারী করে কোনো একটি বিন্দুতে মিলিত করে (চিত্র ৫.০৫)। এই বিন্দুটি হচ্ছে লেন্সের ফোকাস বিন্দু এবং লেন্সের কেন্দ্র থেকে এই বিন্দুর দূরত্ব হচ্ছে ফোকাস দূরত্ব। উত্তল লেন্সে আলো এক বিন্দুতে মিলিত হওয়ার পর সেটি আবার ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে অবতল লেলের মাঝাখানে সন্তু ও প্রান্তের দিকটা মোটা (চিত্র ৫.০৬)। এই লেন্সের অবতল পৃষ্ঠে সমান্তরাল আলোক রশ্মি আপতিত হলে আলোকরশ্মি অপসারী হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। যদি অপসারিত রশ্মিগুচ্ছ সোজা পিছনের দিকে বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে কল্পনা করে নিলে সেগুলো একটি বিন্দুতে মিলিত হচ্ছে বলে মনে হয়। এই বিন্দুটি হচ্ছে অবতল লেন্সের ফোকাস বিন্দু এবং লেন্সের কেন্দ্র থেকে এই বিন্দুর দূরত্ব হচ্ছে ফোকাস দূরত্ব।

সাধারণত লেন্সের পৃষ্ঠগুলো যে গোলকের অংশ, তার কেন্দ্রকে বক্রতার কেন্দ্র বলে এবং লেন্সের দুই পৃষ্ঠের জন্য বক্রতার কেন্দ্র দুটি। বক্রতার কেন্দ্র দুটির মধ্য দিয়ে গমনকারী সরলরেখাই হলো লেন্সের প্রধান অক্ষ। আমরা আগেই বলেছি যে লেন্সের প্রধান অক্ষের সমাচ্চরাল রশ্মি প্রতিসরণের পর প্রধান অক্ষের যে বিন্দুতে মিলিত হয় (উত্তল লেন্স) বা যে বিন্দু থেকে অপসৃত হচ্ছে বলে মনে হয় (অবতল লেন্স), সেই বিন্দুকে লেন্সের প্রধান ফোকাস বলে। ৫.০৫ এবং ৫.০৬ চিত্রে F বিন্দু হলো প্রধান ফোকাস। লেন্সের কেন্দ্র থেকে প্রধান ফোকাস পর্যন্ত দূরত্বই হলো লেন্সের ফোকাস দূরত্ব।

 

৫.৩.১ লেন্সের ক্ষমতা

আমরা জানি, প্রধান অক্ষের সমান্তরাল এক পুচ্ছ আলোকরশ্মিকে উত্তল লেন্স কেন্দ্রীভূত বা অভিসারী করে এক বিন্দুতে মিলিত করে। অপরদিকে অবতল লেন্স একগুচ্ছ সমান্তরাল রশ্মিকে অপসারী করে; ফলে ঐ রশ্মিগুচ্ছ কোনো একটি বিন্দু থেকে অপসারিত হচ্ছে বা ছড়িয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। আলোকরশ্মিকে অভিসারী বা অপসারী করার প্রক্রিয়াটি পরিমাপ করার জন্য লেন্সের “ক্ষমতা" সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ১-কে লেন্সের ফোকাস দূরত্ব (মিটারে প্রকাশ করে) দিয়ে ভাগ করা হলে লেন্সের ক্ষমতা বের হয়। অর্থাৎ একটি উত্তল লেন্সের ফোকাস দূরত্ব ২ মিটার হলে তার ক্ষমতা ১/২ - ০.৫। লেন্সের ক্ষমতার প্রচলিত একক হলো ডারস্টার (diopter)। এর এসআই একক হলো রেডিয়ান/মিটার। লেলের ক্ষমতা ধনাত্মক বা ঋণাত্মক দুই-ই হতে পারে। কোনো লেলের ক্ষমতা +1D বলতে বোঝায়, লেন্সটি উত্তল এবং এটি প্রধান অক্ষের ১ মিটার দূরে আলোকরশ্মিগুচ্ছকে মিলিত করবে।একইভাবে লেলের ক্ষমতা - 2D হলে বুঝতে হবে লেন্সটি অবতল এবং এটি প্রধান অক্ষের সমান্তরাল একগুচ্ছ আলোকরশ্মিকে এমনভাবে অপসারিত করে যে, এগুলো কোনো লেন্স থেকে ৫০ সেমি দূরের কোনো বিন্দু থেকে অপসৃত হচ্ছে বলে মনে হয়।

Content added || updated By

চিত্র ৫.০৭: আমরা কীভাবে দেখি

৫.৪.১ আমরা কীভাবে দেখতে পাই

তোমরা অষ্টম শ্রেণিতে চোখের গঠন সম্পর্কে জেনেছ। বর্তমান পাঠে চোখের ক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা কীভাবে দেখতে পাই (চিত্র ৫.০৭) সেটি আলোচনা করা হবে।

চোখের উপাদানগুলোর মাঝে রয়েছে রেটিনা, চোখের লেন্স, অ্যাকুয়াস হিউমার, ভিট্রিয়াস হিউমার এবং কর্নিয়া। তোমরা লেন্স কীভাবে কাজ করে তার একটি ধারণা পেয়েছ। তাই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ চোখের লেন্সও একটি অভিসারী লেন্সের মতো কাজ করে। আমরা দেখেছি, উত্তল বা অভিসারী লেন্স সবসময় উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরি করে। ক্যামেরায় ছবি তোলার জন্য এভাবে প্রতিবিম্ব তৈরি করা হয়। যখনই আমাদের সামনে কোনো বস্তু থাকে, তখন ঐ বস্তু থেকে আলোকরশ্মি এই লেন্স দ্বারা প্রতিসারিত হয় এবং রেটিনার ওপর একটি উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরি করে। রেটিনার ওপর আলো পড়লে স্নায়ুর সাথে সংযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রড এবং কোণ কোষগুলো সেই আলো গ্রহণ করে তাকে তড়িৎ বা বিদ্যুৎ সিগন্যালে পরিণত করে। স্নায়ু এই বিদ্যুৎ বা তড়িৎ সিগন্যালকে তাৎক্ষণিকভাবে অপটিক নার্ভ বা অক্ষি স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠায়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কোণকোষগুলো তীব্র আলোতে সাড়া দেয় এবং রঙের অনুভূতি ও রঙের পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়। অন্যদিকে রডকোষগুলো খুব কম আলোতে সংবেদনশীল হয়। এ জন্য জ্যোৎস্নার অল্প আলোতে আমরা “রড” কোষগুলোর কারণে দেখতে পাই কিন্তু কোনো রং বুঝতে পারি না। মস্তিষ্ক রেটিনায় সৃষ্ট উল্টো প্রতিবিম্বকে সোজা করে নেয় বলে আমরা বস্তুটি যে রকম থাকে সেরকমই দেখি ।

৫.৪.২ স্পষ্ট দৃষ্টির ন্যূনতম দূরত্ব

স্বাভাবিক চোখের খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা সীমাহীন নয়। মানুষ তার চোখের লেন্সে ফোকাস দূরত্ব বাড়িয়ে বা কমিয়ে একটা বস্তুকে সব সময় স্পষ্ট দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু লক্ষ্যবস্তু চোখের কাছাকাছি একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে বেশি কাছে এলে আর স্পষ্ট দেখা যায় না। চোখের সবচেয়ে কাছে যে বিন্দু পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুকে খালি চোখে স্পষ্ট দেখা যায়, তাকে স্পষ্ট দৃষ্টির নিকট বিন্দু বলে এবং চোখ থেকে ঐ বিন্দুর দূরত্বকে স্পষ্ট দৃষ্টির ন্যূনতম দূরত্ব ধরে নেওয়া হয় । এই দূরত্ব মানুষের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। একজন শিশুর এই দূরত্ব ৫ সেন্টিমিটারের কাছাকাছি এবং একজন স্বাভাবিক বয়স্ক লোকের এই দূরত্ব ২৫ সেমি পর্যন্ত হতে পারে। দূর বিন্দু চোখ থেকে অসীম দূরত্বে অবস্থান করে। এ কারণে আমরা বহুদূরের নক্ষত্রও খালি চোখে দেখতে পারি।

৫.৪.৩ চোখের ত্রুটি এবং তার প্রতিকার

তোমাদের কি চোখের সমস্যা সম্পর্কে ধারণা আছে? এ পাঠে আমরা চোখের বিভিন্ন ত্রুটি এবং তাদের প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করব।

আমরা জানি, সুস্থ এবং স্বাভাবিক চোখ “নিকট বিন্দু” (Near point) থেকে শুরু করে অসীম দূরত্বের দূর বিন্দুর মাঝখানে যে স্থানেই কোনো বস্তু থাকুক না কেন সেটা স্পষ্ট দেখতে পারে। এটাই চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি। এই স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ব্যাহত হলেই তাকে চোখের দৃষ্টির ত্রুটি বলা হয়।চোখের দৃষ্টির অনেক ধরনের ত্রুটি থাকলেও আমরা প্রধান দুটি ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করব। সেই দুটি

(ক) হ্রস্বদৃষ্টি বা ক্ষীণদৃষ্টি (Myopia or shortsightedness)

(খ) দীর্ঘদৃষ্টি বা দুরদৃষ্টি ( Hypermetropis or farsightedness)

 

হ্রস্বদৃষ্টি বা ক্ষীণদৃষ্টি (Myopia)

যখন চোখ কাছের বস্তু দেখতে পায় কিন্তু দূরের বস্তু দেখতে পায় না, তখন চোখের এই জুটিকে হ্রস্বদৃষ্টি বলে। এরূপ চোখের দূর বিন্দুটি অসীম দূরত্ব অপেক্ষা খানিকটা নিকটে থাকে এবং বস্তুকে স্পষ্ট দৃষ্টির ন্যূনতম দূরত্ব হতে আরও কাছে আনলে অধিকতর স্পষ্ট দেখায়। নিম্নলিখিত দুটি কারণে এই ত্রুটি হয়ে থাকে।

১. চোখের লেন্সের অভিসারী শক্তি বৃদ্ধি পেলে বা ফোকাস দূরত্ব কমে গেলে এ

২. কোনো কারণে অক্ষিগোলকের ব্যাসার্ধ বৃদ্ধি পেলে।

এর ফলে দূরের বস্তু থেকে আসা আলোকরশ্মি চোখের লেন্সের মধ্য দিরে প্রতিসরণের পর রেটিনার উপরে প্রতিবিম্ব তৈরি না করে একটু সামনে (F) প্রতিবিম্ব তৈরি করে (চিত্র ৫.০৮)। ফলে চোখ বস্তুটি স্পষ্ট দেখতে পায় না ।

প্রতিকার : এই ত্রুটি দূর করার জন্য এমন একটি অবতল লেন্সের চশমা ব্যবহার করতে হবে, যার ফোকাস দূরত্ব হ্রস্বদৃষ্টির দীর্ঘতম দূরত্বের সমান। চশমার এই লেন্সের অপসারী ক্রিয়া চোখের উত্তল লেন্সের অভিসারী ক্রিয়ার বিপরীত কাজেই চোখের ফোকাস দূরত্ব বেড়ে যাবে বলে প্রতিবিম্বটি আরো পিছনে তৈরি হবে। অর্থাৎ অসীম দূরত্বের বন্ধু থেকে আসা সমান্তরাল আলোকরশ্মি চশমার অবতল লেল L (চিত্র ৫.০৮) এর মধ্য দিয়ে চোখে পড়ার সময় প্রয়োজনমতো অপসারিত হয়। এই অপসারিত রশ্মিগুলো চোখের লেলে প্রতিসারিত হয়ে ঠিক রেটিনা বা অক্ষিপট R-এর ওপর স্পষ্ট প্রতিবিম্ব তৈরি করে।

চিত্র ৫.০৯: দীর্ঘদৃষ্টি ও তার প্রতিকার

দীর্ঘদৃষ্টি বা দূরদৃষ্টি (Hypermetropia)

যখন কোনো চোখ দূরের বস্তু দেখে কিন্তু কাছের বস্তু দেখতে পায় না, তখন এই জুটিকে দীর্ঘদৃষ্টি বলে। সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে এই জুটি দেখা যায়। নিম্নলিখিত দুটি কারণে এই ত্রুটি ঘটে।

১. চোখের লেন্সের অভিসারী ক্ষমতা হ্রাস পেলে অথবা চোখের লেন্সের ফোকাস দূরত্ব বেড়ে গেলে।

২. কোনো কারণে অক্ষিগোলকের ব্যাসার্ধ কমে গেলে।

এর ফলে দূর থেকে আসা আলো সঠিকভাবে চোখের রেটিনাতে প্রতিবিম্ব তৈরি করলেও কাছাকাছি বিন্দু থেকে আসা আলোকরশ্মি চোখের লেন্সের মধ্য দিয়ে প্রতিসরণের পর রেটিনার ঠিক উপরে না হয়ে পিছনে (F) বিন্দুতে মিলিত হয় (চিত্র ৫.০৯)। ফলে চোখ কাছের বস্তু স্পষ্ট দেখতে পায় না।

প্রতিকার : এই ত্রুটি দূর করার জন্য একটি উত্তল লেন্সের চশমা ব্যবহার করতে হবে। ফলে কাছাকাছি বিন্দু (চিত্র ৫.০৯) থেকে আসা আলোকরশ্মি চশমার লেন্সে এবং চোখের লেলে পর পর দুইবার প্রতিসারিত হওয়ার কারণে ফোকাস দূরত্ব কমে যাবে এবং প্রয়োজনমতো অভিসারী হয়ে প্রতিবিম্বটি রেটিনা (R)-এর উপরে পড়বে।

৫.৪.৪ চোখ ভালো রাখায় উপায়

আমাদের চোখ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এটির যথাযথ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন যেন এটিকে ত্রুটিমুক্ত রাখা যায়। বিভিন্ন উপায়ে আমাদের চোখকে ভালো রাখা যায়। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কথা বলা যেতে পারে :

(ক) সঠিক পুষ্টি গ্রহণ চোখের জন্য খুবই দরকারি। ভিটামিন এ, সি ও ই সমৃদ্ধ খাবার; ফ্যাটি এসিড যুক্ত খাবার, জিংকসমৃদ্ধ খাবার, গাঢ় সবুজ শাকসবজি ও বিভিন্ন ফল চোখের জন্য খুবই ভালো। এ ধরনের খাবার চোখকে রোগমুক্ত রাখতে সহায়তা করে। গাজর, মাছ, ব্রকলি, গম, মিষ্টি কুমড়া, হলুদ (যেমন, পাকা পেঁপে, আম) ফল ইত্যাদি বেশি করে খেতে হবে।

(খ) চোখের সঠিক যত্নের জন্য সঠিক জীবনধারণ পদ্ধতি মেনে চলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সারা দিনের পরিশ্রমের পর শরীরের মতো চোখও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। চোখকে পুনরায় সতেজ করতে সারা রাত ঘুমানো প্রয়োজন। তাই এই নির্ধারিত সময় ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপানও চোখের ক্ষতি করে। তাই ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। কেউ যদি রোদ থেকে চোখকে রক্ষা করার জন্য সানগ্লাস ব্যবহার করতে চায় তাহলে অবশ্যই অতিবেগুনি রশ্মি প্রতিহত করতে পারে এমন সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে। তেল দিয়ে রান্না করার সময় কিংবা ঝালাইয়ের কাজ করার সময় যখন উত্তপ্ত কণা ছিটকে আসে, তখন খুব সাবধান থাকতে হবে। তাছাড়া কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করার সময় চোখ রক্ষা করার সেফটি গ্লাস পরা বুদ্ধিমানের কাজ।

(গ) আবছা বা অপর্যাপ্ত আলোতে কাজ করলে সবকিছু চোখের খুব কাছে এনে দেখতে হয়, সেটি চোখের জন্য ক্ষতিকর। ঘরের আলো পর্যাপ্ত রাখতে হবে যেন পড়তে অসুবিধা না হয়। চোখকে যখন ক্লান্ত মনে হবে, তখন না পড়ে বিশ্রাম নেওয়া ভাল। আমাদের চোখের স্পষ্ট দর্শনের ন্যূনতম দূরত্ব থেকে কম বা বেশি দূরত্বে রেখে বই পড়লে চোখে চাপ পড়ে। তাই সঠিক দূরত্বে রেখে বই পড়তে হয়। তুমি হয়তো খেয়াল করেছ অনেকক্ষণ ধরে কম্পিউটার ব্যবহার করলে চোখ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘক্ষণ টেলিভিশন দেখা বা কম্পিউটার ব্যবহারে চোখের ক্ষতি হয়। তাই এই ক্ষতি থেকে চোখকে রক্ষা করতে নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে এবং বিরতি দিয়ে টেলিভিশন দেখা বা কম্পিউটার ব্যবহার করা উচিত।

Content added By